লাজ-লজ্জা, অপমানহীন একটা মানুষ ভাবা যায়! আমাদের ক্লাসে রনিটা ঠিক তেমন, হোমওয়ার্ক করে আনেনি বলে বিষু স্যার ওকে পা ওল্টিয়ে মাথা নিচ দিয়ে দেয়ালে আটকে থাকার শাস্তি দিয়েছেন। এই শাস্তির পরও ওর কোন ভাবান্তর নেই। ক্লাসে বসে আমাদের সবার যেখানে হার্টবিট শুরু হয়ে গেছে (কখন কার ভাগ্যে এই শাস্তি জোটে) ও সেখানে পা নাচিয়ে বান্দর নাচের মতো আমাদের হাসানোর চেষ্টা করছে। ওর উপর রাগটা কী পরিমাণে উঠছে স্যার না থাকলে বুঝিয়ে দিতাম!
বিষু স্যারকে আমরা যমের মতো ভয় পাই। স্যারের ক্লাসে একটু অমনোযোগী হলেই ধরা। স্যার যাদু জানেন কিনা জানি না, কোন ছেলে বা মেয়েটা তার পড়ায় মন দিচ্ছে না সাথে সাথেই বুঝে ফেলেন। সেদিন আমি ক্লাসে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ‘শরৎ চন্দ্রের’ বেচারা দেবদাসকে নিয়ে ভাবছিলাম। কাল রাত্রে সদ্য উপন্যাসটা শেষ করেছিলাম কিনা। এমন সময় দেবদাসের পন্ডিতের মতো বিষু স্যার আমার কান টেনে বললেন, “হতচ্ছাড়া কোথাকার! পড়ায় মন না দিয়ে কার কথা ভাবা হচ্ছে? হু!”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “সত্যি বলছি স্যার, কোন কারো কথা ভাবিনি!”
এতে হাসার কি আছে আমার জানা নেই কিন্তু পুরো ক্লাস হেসে তোলপাড় হয়ে গেল। রাগে আমার গা ঝা ঝা করতে লাগল। ভাগ্যিস, স্যার চুপ করতে বললেন নইলে নিজেই গলা ফাটিয়ে চুপ করাতাম। সামান্য এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমার কপালে জুটল, স্কুল মাঠে মাথা পায়ের নিচে দিয়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছে বলার মতো নয়! সিনিয়র জুনিয়র সবাই আমায় দেখে মুখ টিপে হেসেছে। এখনো দেখা হলে কেউ কেউ সে কথা স্মরণ করে হাসে।
সেদিন থেকে ভাবলাম, স্যারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব। নজরুল যেমন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কবিতা লেখা শুরু করেছিল আমিও তেমনি স্কুল ম্যাগাজিনে স্যারের বিরুদ্ধে আগুন-জ্বালা সব কবিতা লেখা শুরু করলাম। তবে কবিতায় স্যারের নাম উল্লেখ করার সাহস পাইনি। ইনডাইরেক্টলি লিখেছি, উপমা দিয়ে। স্যার বুঝতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। মাথাধরা অংকের টিচার, বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই তো?
আমার কবিতার কারণে কিংবা অন্য কারণে জানি না আমাদের স্কুলে আত্মস্বীকৃত সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ‘লতফ শাহম’ স্যার আমায় ডেকে পাঠালেন। স্যারের নাম দেখে চমকে উঠার কিছু নেই। আসলে স্যারের আসল নাম “লতিফুজ্জামান শাহ আলম”। কিন্তু সাহিত্যিকদের নাম নাকি কাব্যিক হতে হয় তাই স্যার পরিবর্তন করে ‘লতফ শাহম’ রাখেন। স্যারের ভাব ভঙ্গিতেও পুরো কবি। সাদা পাঞ্জাবী, একটা চটের ব্যাগ আর গরম ঠান্ডা যাই হোক একটা চাদর সবসময় শরীরে জড়িয়ে রাখেন। স্যারের রুমে যেতেই আমায় সাদরে বললেন, “এসো হে এসো, হৃষ্ট চিত্তে বসো!”
তারপর স্যার আতঁকে উঠে বললেন, “একি! তোমার চেহারায় তো কবিত্বের চিহ্ন নেই। মনের ভিতর ভেজা আবেগটুকুও তো দেখতে পাই না।”
চেহারায় কবিত্বের চিহ্ন ভেসে উঠে কিনা আমার জানা নেই। আর আবেগ যে শুধু ভেজা হবে তার শর্তই বা কে দিয়েছে? গরম, ঠান্ডা, ভেজা, নাতিশীতোষ্ণ ও হতে পারে।
স্যারের কথার কি উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে বললাম, “স্যার আমি কিন্তু আপনার কবিতা খুব পছন্দ করি।” কথাটা বলে বোধ হয় ভুলই করলাম।
স্যার বেশ ভাব নিয়ে বললেন, “সেটা তো করতেই হবে। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান বলতেই তো আমরা। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ঞকীর্তন আর রবিঠাকুরের যুগ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আমার কাব্যের উপমা, ছন্দ, অলংকার সেসব থেকেও নাকি অনেক উঁচু মানের বলে, অনেক পন্ডিত মনে করেন। ”
পন্ডিতগুলো যে কে একটু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সাহস পেলাম না।
তারপর আবার বললেন, “তুমি কি আমার ‘নোনা জলে পদ্ম’ কবিতাটা পড়েছ? অসাধারণ এক কবিতা। বাংলা সাহিত্যে সোনার তরীর পরে স্থান দেয়া যায়। তোমাদের মত বালকদের নিয়ে ‘গাঁধাবেলা’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম। দাঁড়াও শুনাচ্ছি-
মস্তিষ্কের আহ্বানে
ছেলেগুলো হচ্ছে গাঁধা,
গাঁধাবেলার অনন্ত সুপ্রাতে
পরীক্ষার খাতা সাদা।
কি কেমন হল? বাংলা সাহিত্যে এমন কয়টা কবিতা আছে, হ্যাঁ?”
আমি খুব জোড় দিয়েই বললাম,“একটাও না। বাংলা সাহিত্যে এত নিপাতে যায়নি !”
শেষ কথাটা বোধ হয় লক্ষ্য করেননি। তাই খুশি হয়ে গেলেন।
স্যারের এমন উদ্ভট কবিতা শোনার চেয়ে মুক্তি পেলে বাঁচি।
তাই স্যারকে বিনীতভাবে বললাম,“আমায় কি জন্য ডেকেছেন স্যার?”
এবার বোধ হয় স্যারের ভাব একটু ভাঙ্গল। তারপর গলা খেকড়ে বললেন,“হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তুমি স্কুল ম্যাগাজিনে যে সব কবিতা লিখেছ তা কবিতা না বলে কপিতা বলা ভাল। বিদ্রোহী কবি মানে নজরুল, শেলী। ওদের ভাব , বাক্য নকল করার কোন মানে হয় না। নকল করে কবি হওয়া যায় না, বুঝলে বাছা। সৃজনশীলতাই হচ্ছে কবিতার মূল শক্তি।এই দেখনা আমাকে,সৃজনশীলতার কতো উদাহরণ রেখে যাচ্ছি। আর তুমি তো আমার কবিতা পড়েছ, সৃজনশীলতার অনন্য উদাহরণ।”
আমার তখন ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করি, স্যার আপনি নজরুল আর শেলীর কয়টা কবিতা পড়েছেন? তবে এটা ভেবে বেশ গর্ব হল, আমার কবিতা নজরুলের মতো।
আসার সময় স্যার ডাইরীর একটা পাতা ছিড়ে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে বললেন, “আমি জানি তুমি আমার অটোগ্রাফ চাইতে। মুখ ফুটে বলতে পারছ না। তাই নিজেই দিয়ে দিলাম। তাছাড়া অন্য সময় আসলে নাও পেতে পার। জানই তো কবিদের আশেপাশে ভিড় লেগেই থাকে।”
বিষু স্যারকে আমরা যমের মতো ভয় পাই। স্যারের ক্লাসে একটু অমনোযোগী হলেই ধরা। স্যার যাদু জানেন কিনা জানি না, কোন ছেলে বা মেয়েটা তার পড়ায় মন দিচ্ছে না সাথে সাথেই বুঝে ফেলেন। সেদিন আমি ক্লাসে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে ‘শরৎ চন্দ্রের’ বেচারা দেবদাসকে নিয়ে ভাবছিলাম। কাল রাত্রে সদ্য উপন্যাসটা শেষ করেছিলাম কিনা। এমন সময় দেবদাসের পন্ডিতের মতো বিষু স্যার আমার কান টেনে বললেন, “হতচ্ছাড়া কোথাকার! পড়ায় মন না দিয়ে কার কথা ভাবা হচ্ছে? হু!”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “সত্যি বলছি স্যার, কোন কারো কথা ভাবিনি!”
এতে হাসার কি আছে আমার জানা নেই কিন্তু পুরো ক্লাস হেসে তোলপাড় হয়ে গেল। রাগে আমার গা ঝা ঝা করতে লাগল। ভাগ্যিস, স্যার চুপ করতে বললেন নইলে নিজেই গলা ফাটিয়ে চুপ করাতাম। সামান্য এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমার কপালে জুটল, স্কুল মাঠে মাথা পায়ের নিচে দিয়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। সেদিন আমার কি অবস্থা হয়েছে বলার মতো নয়! সিনিয়র জুনিয়র সবাই আমায় দেখে মুখ টিপে হেসেছে। এখনো দেখা হলে কেউ কেউ সে কথা স্মরণ করে হাসে।
সেদিন থেকে ভাবলাম, স্যারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব। নজরুল যেমন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কবিতা লেখা শুরু করেছিল আমিও তেমনি স্কুল ম্যাগাজিনে স্যারের বিরুদ্ধে আগুন-জ্বালা সব কবিতা লেখা শুরু করলাম। তবে কবিতায় স্যারের নাম উল্লেখ করার সাহস পাইনি। ইনডাইরেক্টলি লিখেছি, উপমা দিয়ে। স্যার বুঝতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। মাথাধরা অংকের টিচার, বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই তো?
আমার কবিতার কারণে কিংবা অন্য কারণে জানি না আমাদের স্কুলে আত্মস্বীকৃত সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ‘লতফ শাহম’ স্যার আমায় ডেকে পাঠালেন। স্যারের নাম দেখে চমকে উঠার কিছু নেই। আসলে স্যারের আসল নাম “লতিফুজ্জামান শাহ আলম”। কিন্তু সাহিত্যিকদের নাম নাকি কাব্যিক হতে হয় তাই স্যার পরিবর্তন করে ‘লতফ শাহম’ রাখেন। স্যারের ভাব ভঙ্গিতেও পুরো কবি। সাদা পাঞ্জাবী, একটা চটের ব্যাগ আর গরম ঠান্ডা যাই হোক একটা চাদর সবসময় শরীরে জড়িয়ে রাখেন। স্যারের রুমে যেতেই আমায় সাদরে বললেন, “এসো হে এসো, হৃষ্ট চিত্তে বসো!”
তারপর স্যার আতঁকে উঠে বললেন, “একি! তোমার চেহারায় তো কবিত্বের চিহ্ন নেই। মনের ভিতর ভেজা আবেগটুকুও তো দেখতে পাই না।”
চেহারায় কবিত্বের চিহ্ন ভেসে উঠে কিনা আমার জানা নেই। আর আবেগ যে শুধু ভেজা হবে তার শর্তই বা কে দিয়েছে? গরম, ঠান্ডা, ভেজা, নাতিশীতোষ্ণ ও হতে পারে।
স্যারের কথার কি উত্তর দেব ভেবে না পেয়ে বললাম, “স্যার আমি কিন্তু আপনার কবিতা খুব পছন্দ করি।” কথাটা বলে বোধ হয় ভুলই করলাম।
স্যার বেশ ভাব নিয়ে বললেন, “সেটা তো করতেই হবে। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান বলতেই তো আমরা। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ঞকীর্তন আর রবিঠাকুরের যুগ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আমার কাব্যের উপমা, ছন্দ, অলংকার সেসব থেকেও নাকি অনেক উঁচু মানের বলে, অনেক পন্ডিত মনে করেন। ”
পন্ডিতগুলো যে কে একটু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সাহস পেলাম না।
তারপর আবার বললেন, “তুমি কি আমার ‘নোনা জলে পদ্ম’ কবিতাটা পড়েছ? অসাধারণ এক কবিতা। বাংলা সাহিত্যে সোনার তরীর পরে স্থান দেয়া যায়। তোমাদের মত বালকদের নিয়ে ‘গাঁধাবেলা’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম। দাঁড়াও শুনাচ্ছি-
মস্তিষ্কের আহ্বানে
ছেলেগুলো হচ্ছে গাঁধা,
গাঁধাবেলার অনন্ত সুপ্রাতে
পরীক্ষার খাতা সাদা।
কি কেমন হল? বাংলা সাহিত্যে এমন কয়টা কবিতা আছে, হ্যাঁ?”
আমি খুব জোড় দিয়েই বললাম,“একটাও না। বাংলা সাহিত্যে এত নিপাতে যায়নি !”
শেষ কথাটা বোধ হয় লক্ষ্য করেননি। তাই খুশি হয়ে গেলেন।
স্যারের এমন উদ্ভট কবিতা শোনার চেয়ে মুক্তি পেলে বাঁচি।
তাই স্যারকে বিনীতভাবে বললাম,“আমায় কি জন্য ডেকেছেন স্যার?”
এবার বোধ হয় স্যারের ভাব একটু ভাঙ্গল। তারপর গলা খেকড়ে বললেন,“হ্যাঁ, যা বলছিলাম, তুমি স্কুল ম্যাগাজিনে যে সব কবিতা লিখেছ তা কবিতা না বলে কপিতা বলা ভাল। বিদ্রোহী কবি মানে নজরুল, শেলী। ওদের ভাব , বাক্য নকল করার কোন মানে হয় না। নকল করে কবি হওয়া যায় না, বুঝলে বাছা। সৃজনশীলতাই হচ্ছে কবিতার মূল শক্তি।এই দেখনা আমাকে,সৃজনশীলতার কতো উদাহরণ রেখে যাচ্ছি। আর তুমি তো আমার কবিতা পড়েছ, সৃজনশীলতার অনন্য উদাহরণ।”
আমার তখন ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করি, স্যার আপনি নজরুল আর শেলীর কয়টা কবিতা পড়েছেন? তবে এটা ভেবে বেশ গর্ব হল, আমার কবিতা নজরুলের মতো।
আসার সময় স্যার ডাইরীর একটা পাতা ছিড়ে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে বললেন, “আমি জানি তুমি আমার অটোগ্রাফ চাইতে। মুখ ফুটে বলতে পারছ না। তাই নিজেই দিয়ে দিলাম। তাছাড়া অন্য সময় আসলে নাও পেতে পার। জানই তো কবিদের আশেপাশে ভিড় লেগেই থাকে।”